Blog

বাঙলা পরিভাষা কঠিন মনে হয় কেন?

by মনসুর মুসা

বাঙালী জীবনের কেন্দ্রীয়-পর্যায়ে স্বভাগা থাকবে না পরভাষ। থাকবে এ প্রশ্ন মীমাংসিত হয়ে গেছে। বাঙলা ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ১৯৭২ সালে, আর ১৯৮৭ সালে দেওয়া হয়েছে আইনগত স্বীকৃতি। স্বীকৃতির সমস্যা ঢুকে গেলেও স্বীকরণের সমস্যা চুকে যায়নি। পরতামার সমস্যা মিটলেও পরিভাষার সমস্যা মিটে নি। ইদানীং অনেকেই সর্বস্তরে বাঙলা প্রচলনের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছেন। 'বাঙলা- প্রচলন-সমস্যা'র 'আলোচকের। সচরাচর পরিভাষাকে বাঙল। প্রচলনের অন্তরার হিসেবে চিহ্নিত করতে উৎসাহিত হন। সবাই যে একইভাবে পরিভাষাকে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করেন তা নয়; কেউ-বা একে প্রধান সমস্যা বিবেচনা করেন, কেউবা বিবেচনা করেন অপ্রধান সমস্যা হিসেবে। উত্তর দলেরই বন্ধমূল ধারণা যে, পরিভাষা বাঙলা-ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনের অন্যতম প্রতিবন্ধক। এই প্রবন্ধের বিষয় হলো-'বাঙলা পরিভাষা কঠিন মনে হয় কেন?'-এই প্রশ্নের যুক্তি-নির্ভর মীমাংসা উত্থাপন করা। যে কাজ করতে হলে 'পরিভাষা কী?', 'বাঙলা পরিভাষার বিশেষত্ব কী', 'কঠিন মনে হওয়ার' অনুযোগটি কী-ভাবে আলোচনা করা যেতে পারে? ইত্যাদি বিষয় ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বুঝে নেওয়। প্রয়োজন।
বাঙলা পরিভাগ। কঠিন প্রতিভাত হয় কেন?-এই প্রশ্ন বাঙলাভাষার অবয়ব পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভাগার কোনো রূপাবয়ব ভামীর কাছে গৃহীত হয়ে কি হবেনা সেটা ভাঘার সমাজ-মনস্তত্ত্বের মধ্যে নিহিত। সুতরাং প্রশ্নটির মীমাংসা খুঁজতে গেলে ভাষার সমাজ-মনস্তত্বের দিকে উ'কি দিতে হবে। আমরা এদিকে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।
বাঙলা পরিভাষার কঠিনতার কথা আলোচনার আগে তাঘায় পরিভাষা বলতে কোন্ ধরনের শব্দকে ইঙ্গিত করা হয় তা স্বচ্ছ করে নেওয়া আবশ্যিক।
প্রতিটি ভাষায় অজস্র শব্দ থাকে। কোনে। শব্দ প্রাত্যহিক, কোন শব্দ সাহিত্যিক, কোনো শব্দ প্রচলিত, কোনে। শব্দ অচলিত, কোনে। শব্দ স্বকৃত, কোনো শব্দ স্বাণকৃত। পরিভাষাও এক ধরণের শব্দ। তবে পারিভাষিক শব্দের সঙ্গে অপারিভাষিক শব্দের পার্থক্য আছে, সে পার্থক্য শব্দের অবয়বে নয়, অর্থে বা অর্থের বিশেষত্বে। যে-কোনে। জ্ঞানগর্ভ আলোচনার কতক- গুলো শব্দ প্রাধান্য লাভ করে, পৌনপুনিকভাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ মানুষের গভীরতর চিন্তার ক্ষেত্রে কতকগুলো ধারণা বিশেষ তাৎপর্য ও সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মনে করা যাক, আমরা কম্পিউটার বিষয়ক আলোচনায় ব্যাপৃত আছি। আমাদের আলোচনার গন্ডীব মধ্যে স্বাভাবিকভাবে সফট- ওয়্যার, হার্ডওয়‍্যার, প্রোগ্রামিং, ডিজাইন, বকসোলজী, মন্টিকার্লো পদ্ধতি, সিমপসন সূত্র, লিনিয়ার মডেল, রো, কলাম, অর্ডার, কমাও, লগ, ম্যাট্রিক্স, আইল্যান্ড, প্যাকেজ, কনসট্রেইন্ট, লুপ, ট্রি, বিং, স্টার, ডাটা, গার্বেজ ইত্যাদি আরে। বহু শব্দ এসে যেতে পারে। এ-সব শব্দ কম্পিউটার বিজ্ঞানের তাৎপর্যমর ধারণা হিসেবেই আলোচনায় প্রাধান্য বিস্তার করবে। ধারণাগুলে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ধারণারাশির প্রধান অংশ। ধারণাগুলোর জন্য যে সকল শব্দ ব্যবহৃত, তাদের বলা যাবে কম্পিউটার বিজ্ঞানের পরিভাষা বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের পরিভাষিক শব্দ।
মনে করা যাক, আমর। ভাষাবিজ্ঞানের কথা আলোচন। করছি। ভাষাতত্ত্বের আলোচনার মূলধ্বনি, সহধ্বনি, মূলরূপ, সহরূপমূল, শব্দক্রম, রূপান্তর, প্রস্বর, স্বরভঙ্গী, গ্রীমের সূত্র, ভারনারের সূত্র, প্রতিবেশ, পরিপূরক অবস্থান, দ্বিবাচন, সুভাষণ আরো বহু শব্দ বিশেষভাবে ব্যবহার করি। এ শব্দগুলোর অর্থের সঙ্গে পরিচয় না থাকলে বিষয়ালোচন। জ্ঞানতত্ত্বের মর্যাদালাভ করবে না।
কিংবা আমরা যদি রসশাস্ত্রের আলোচনার প্রবৃত্ত হই, তবে রস, সহৃদয়-হৃদয়সংবাদী, ফোটবাদ, ব্যঞ্জনা, ভাব, বিভাব, অনুভাব, ভাব-বিমোক্ষণ বা ক্যাথারসিস ইত্যাদি ধারণা প্ররোগ করব। সহজ কথায় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে যেগুলো ধারণা হিসেবে চিহ্নিত হয় সেগুলো ভাষার ক্ষেত্রে পরিচিহ্নিত হয় পরিভাষা হিসেবে। অর্থাৎ যেকোন আলোচ্য জ্ঞানক্ষেত্রের তাৎপর্যপূর্ণ ধারণাগুলোর ভাষিক অবয়বকে (Language Corpus) সাধারণত পারিভাষিক শব্দ বা পরিভাষা বলা হয়।
বঙ্গভাষার অন্যতম অভিধানকার রাজশেখর বসু পরিভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, "পরিভাষ। হচ্ছে সংকেপার্থ শব্দ। অর্থাৎ যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনিদিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা। যে শব্দের অনেক অর্থ, যে শব্দও যদি প্রসঙ্গবিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয় তবে তা পরিভাষা-স্থানীয়। সাধারণত 'পরিভাষা' বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলী বোঝার যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন বিজ্ঞানাদির আলোচনার প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না।" (রাজশেখর বসু, ১৩৪০)। প্রাচীন ভারতীর আলংকারিকের। শব্দের তিন বয়নের অর্থের কথা। উল্লেখ করেছেন। অর্থ ঠিক বলেন নি, বলেছেন শব্দের শক্তি। সেই তিনশক্তি হচ্ছে, অভিধাশক্তি, লক্ষণাশক্তি, আর ব্যঞ্জনাশক্তি। তিনশক্তির মধ্যে অভিধাই হচ্ছে পরিভাথার শক্তি। শব্দের যে শক্তিতে তার মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থ প্রতীত হয় অর্থাৎ শব্দের উচ্চারণমাত্রেই তার কোষ- ব্যাকরণাদি প্রসিদ্ধ অনারাসলত্য সহজ মুখ্য অর্থের বোধ হয় তাই অভিধা শক্তি। আধুনিক পরিভাষায় বল। যার শব্দের প্রতিবেশ-নিরপেক্ষ প্রধান ও অনন্য অর্থকে অভিবা বলা যায়। পারিভাষিক শব্দ, অন্য কথায় পরিভাষার অভিধা আছে, তাদের লক্ষণ। ও ব্যঞ্জনার বালাই নেই।
যে-কোনে। শাস্ত্র, বিদ্যা, জ্ঞানশাখা, দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞানগর্ভ আলোচনার অবতরণ করতে হলে পরিভাষার সহায়তা প্রয়োজন। পরিভাষা ভাবের নির্দেশকে সীমাবন্ধ করে। সেজন্য চিন্তার যৌক্তিক বিন্যাসে পরিভাষা অত্যন্ত সহায়ক। যে সব সমাজে নানাবিৰ মৌলিক চিন্তাভাবনা বিকশিত হচ্ছে সে-সব সমাজের ভাষার শব্দ-গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার পরিভাষা নিষিত হচ্ছে। নতুন পরিভাষা যখনই সৃষ্টি হচ্ছে তখনই তার অন্ত- নিহিত জ্ঞান-প্রক্রিয়া শ্রোতা-পাঠকের বোধের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রতি ইউরোপ, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জ্ঞান-প্রকৌশল (Knowledge-Engineering)-এর ক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রগণ্য আছে, সে কারণে পরিভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁদের অবদান অগ্রগণ্য। মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষার কথা আলোচনা করলে দেখা যাবে যে বিজ্ঞানে যে-সব শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে তার প্রায় কোনটাই বাঙলাভাষার নেই। জ্ঞানচর্চা নেই বলে যে জ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিভাষাও বাঙলার নেই। এখন মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষ। বাঙলায় করতে চাইলে যে-বিজ্ঞান যে সমাজে গড়ে উঠেছে সেই সমাজের ভাষায় ধৃত ধারণাকে বাঙলাভাষার রূপান্তর করতে হবে। ফলে তাতে যে সব নতুন শব্দ বাঙলায় জন্ম নেবে সেগুলো বাঙলাভাষার প্রচলিত শব্দের অতিরেক শব্দ হিসেবে উদ্ভুত হবে। শব্দগুলো পরিচিত হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। অনেক শব্দ নতুন সৃষ্টি করতে হবে, অনেক পুরানে। শব্দকে ভেঙ্গেচুরে নব অবরব দিতে হবে, অনেক ক্ষেত্রে ঋণ করে কাজ চালাতে হবে। ব্যাপারটা সহজ করার সহজ উপায় নেই। পরিভাষাকে যদি একটি সামাজিক প্রকৌশল (Social Engineering) হিসেবে দেখা হয় এর তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যাবে। তিনটি পর্যায় হচ্ছে:
১. পরিভাষা-নির্মাণ
২. পরিভাষা-প্রচার
৩. পরিভাষা-প্রয়োগ
১. পরিভাষা-নির্মাণ
ভাষিক দিক থেকে পরিভাষ। হচ্ছে নতুন শব্দসৃষ্টি। নতুন শব্দসৃষ্টি করতে হলে ভাষার রূপমূল, প্রত্যয়, বিভক্তি, সন্ধি, সমাস, ইত্যাদি সম্বন্ধে কার্যকর ধারণা থাকতে হবে। রূপমূল, প্রত্যয় ও বিভক্তিগুলো শব্দ নয়, তবে শব্দ তৈরীর উপকরণ। ভাষার কোন্ উপকরণের সঙ্গে কোন্ উপকরণ সংযুক্ত করলে কোন্ অবয়বের শব্দ নির্মাণ করা যাবে এবং তার সম্ভাব্য অর্থ কি হতে পারে এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। গৃহ-নির্মাণ করতে হলে যেমন ইট-ভাঙার, ছাঁট জোড়া দেওয়ার, ইটের অংশ বিশেষ ব্যবহার করার রীতি আছে, ভাষার শব্দ-নির্মাণের ক্ষেত্রেও শব্দ ভাঙ্গার, শব্দ জোড়া দেওয়ার, শব্দের মধ্যে অর্থ-বিনিয়োগ করার রীতি আছে। এই রীতি-রেওয়াজ ভাষা- বিশেষজ্ঞকে জ্ঞাত থাকলে চলবে না, এট। জানতে হবে বিষয়-বিশেষজ্ঞকেও। প্রচলিত অভিধান পরিভাষ। সৃষ্টি করার অপরিহার্য সহায়ক হলেও একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপকরণ হতে পারে না। বিষয় বিশেষজ্ঞকে কিছুটা ভাষা- বিশেষজ্ঞও হতে হবে পরিভাষ। নির্মাণ করার প্রয়োজনে। বিষয়-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভাষাজ্ঞানের তারতম্য আছে। শুধু বিষয়-জ্ঞান কিংব। শুধু ভাষা-জ্ঞান পরিভাষ। নির্মাণের জন্য যথেষ্ট নয়। পরিভাষা নির্মাণ ভাষা বিশেষজ্ঞতা ও বিষয় বিশেষজ্ঞতার যৌগ-সর্জন। পরিভাষা শ্রম ও মেধার যৌথ কাজ হলেও অনন্তব কাজ নয়। পৃথিবীর সব ভাষাতেই সব পরিভাষা নির্মাণ করা যেতে পারে। নির্মাণ-করা লাভজনক কিনা সেটা ভিন্নতর বিবেচনার যিষয়।। পরিভাষ। নির্মাণ করার নানাবিধ নীতিমালা বাঙালী পণ্ডিতেরাও উপস্থাপন করেছেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র আজ থেকে শতাধিক বছর আগে (১৮৭৭) বাঙলা পরিভাগ। নির্মাণের প্রকল্প তৈরী করেছিলেন। তাঁর বিবেচ্য বিষয় ছিল ইউরোপীর পরিভাষ। দেশীয় ভাষায় রূপান্তর। প্রবন্ধটির নাম-"A Scheme for the rendering of European Scientific terms in the Vernaculars of India." সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় আধুনিক "ভারতীয় ভাষার বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশল পরিভাষা" বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন ১৯৫৩ সালে। করেক বছর আগে বিশ্বভারতী পত্রিকায় পুণ্যশ্লোক রায় "বাঙলা পরিভাষ। সংকলনের রীতিনীতি" বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হক "পরিভাষা” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে বাঙলা পরিভাষা নির্মাণ সংক্রান্ত রীতি-নীতি আলোচনা করেছেন। মুহম্মদ নুরুল হুদা "বাংলা পরিভাষা" প্রণয়ন নীতি প্রসঙ্গে প্রবন্ধ লিখেছেন (১৯৭৭)। বাংলা একাডেমীও এই বিষয়ে বিস্তারিত রীতিনীতিমালা প্রস্তুত করেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা প্রণয়ন ও পরিভাষায় আন্তভাষিক ও আন্তর্জাতিক সমতা আনয়নের চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে 'ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব টামিনোলজী' সংক্ষেপে 'তেরমিরা'র (TERMIA) নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। সুইডেনের সেন্টার ফর টেকনিক্যাল টামিনোলজী (TNC) ১৯৪০ সাল থেকেই নান। জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিভাষা প্রণয়ন ও বিভিন্ন প্রণীত পরিভাষার সমতাবিধানের কাজ করে যাচ্ছে। INFOTERM COCTA নামের দুটো বিশেষজ্ঞ সংস্থাও পরিভাষা নির্মাণের রীতিনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
২. পরিভাষা প্রচার
পরিভাষা-নির্মাণ যেমন সহজ নয়, তেমনি সহজ নয় পরিভাষ। প্রচার কর।। পরিভাষার তালিকা প্রস্তুত করে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে পারলেই যে পরিভাগ। প্রচারিত হবে তার কোনো যানে নেই। পরিভাষ। প্রণয়ন করে যে পরিভাগার যথার্থ প্রয়োগ করে পাঠযোগ্য উপকরণ রচনা করতে পারলেই পরিভাষ। প্রচারে একধাপ অগ্রসর হওয়া যার। উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙলা ভাষায় অনেক পরিভাষ। নির্মিত হয়েছিল। 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা' ও 'প্রকৃতি' পত্রিকার পৃষ্ঠায় এসব পরিভাষা তালিকা মুদ্রিত আছে। কিন্তু এ-সব পরিভাষা পাঠ্য বইতে যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়েছে-একথা বলা যাবে না।
নব্য তুরস্কের জন্মদাতা কামাল আতাতুর্ক ১৯৩২ সালে 'তুর্কী ভাষাতাত্ত্বিক সমিতি' গঠন করেছিলেন। তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল "তুর্কী শব্দ গঠনের মূলনীতি নিরূপণ করে তদনুসারে তুর্কীমূল থেকে নতুন শব্দ নির্মাণ করা।" তাঁর। বিদেশী শব্দের তুর্কী প্রতিশব্দ পাওয়ার জন্য শব্দতালিক। প্রকাশ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমিতির নির্মিত ভাষ। দুর্বোধ্য ও কঠিন এ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বাঙলা একাডেমীর পরিভাষা নিয়েও এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এর কারণ আর কিছু হোক বা না হোক 'অহং' প্রাধান্য যে অন্যতম কারণ তাতে সন্দেহ নেই। সেজন্য আইনার সেলেণ্ডার কৌতুক করে বলেছেন, "The 'best' term for any individual person is created by himself and the 'best' terminology for any individual group is produced by the group itself." আফ্রিকার কিসওয়াহিলী ভাষী রাষ্ট্রগুলো (কেনিয়া, উগান্ডা, জাঞ্জিবার ও তানজানিয়া) Baraza la Kiswahili la Taifa সংক্ষেপে BAKITA নামের একটি ভাষা প্রতিষ্ঠান করেছেন যার কাজ হলে। পরিভাষা নির্মাণ করে, পরিভাষার সমতা বিধান করে, ব্যবহার ও আলোচনার জন্য বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের পণ্ডিতমণ্ডলীর কাছে প্রচার করা। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাঙলার মধ্যে এরকম কোনে। সংযোগসূত্র নেই। ফলে বাঙল। ভাষায় অভিন্নরূপ পরিভাষা নির্মিত ও প্রচারিত হওয়ার পথে সংকট ররে গেছে। শুধু তাই নয়, বাঙলা একাডেমী কিংবা পশ্চিমবঙ্গ পরিভাষা সংসদ যেসব পরিভাষ। প্রণয়ন করছেন সেগুলো ব্যাপকহারে প্রচারের কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই পরিভাষ। নির্মাণের চেয়েও প্রচারের সমস্যা তীব্র।
৩. পরিভাষা-প্রয়োগ
পরিভাষা নির্মাণ কিংবা পরিভাষা-প্রচারে তার সার্থকতা নিছিত নেই, তার সার্থকতা নিহিত রয়েছে তার প্রয়োগযোগ্যতায়। পরিভাষা যদি গৃহীত হয় ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয় তবেই পরিভাব। নির্মাণ তার যৌক্তিক পরিণতি লাভ করবে। সেজন্য পরিভাষা-নির্মাণকারী যে পরিভাষা সৃষ্টি করলে। তার মূল্যায়নের জন্য পরিভাষ। প্রয়োগকারীর সঙ্গে তার ভাষা- তাত্ত্বিক ঐকমত্য থাকতে হবে। নির্মাণকারীর নির্মিত পরিভাষা যদি প্রয়োগকারী গ্রহণ না করে, তবে নির্মাণ ও প্রচার অর্থহীন হয়ে যায়। সে- কারণে নির্মাণকারী, প্রচারকারী ও প্রয়োগকারীর মধ্যে সংযোগ-সূত্র বা নেট- ওয়ার্ক থাকতে হবে। সাধারণত এই ধরনের সংযোগসূত্র বা নেটওয়ার্কের দায়িত্ব পালন করে ভাষা-পরিকল্পন। সংস্থা। বাঙলা পরিভাগ। নির্মিত হরেছে, প্রচারিতও হয়েছে কিন্তু প্রয়োগকারীর সঙ্গে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব কোন সংস্থা গ্রহণ করেনি বলে বাঙল। পরিভাষার প্রয়োগযোগ্যতার মূল্যায়ন হয়নি। সেজন্য বাঙলা একাডেমী কিংবা পশ্চিমবঙ্গ পরিভাষা পরিষদ যখন কোনে। পরিভাষ। নির্মাণ করে তখন যদি কেউ 'পরিভাষ। কঠিন হয়ে গেছে', কিংবা 'উপযুক্ত হয় নি' বলে মন্তব্য করে তাকে স্বীকরণ করানোর কোনো উপায় থাকে না। ভাষা একটি এজমালী সম্পদ। অন্যান্য এজ- মালী সম্পদের মতো এক্ষেত্রেও যুক্তিগত মতৈক্য অজিত হওয়। আবশ্যিক। জাপান সরকারের ভাষা-সম্পৃক্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পদ্ধতি এ-ক্ষেত্রে অনুকরণযোগ্য মনে করি।
বাঙলা ভাষার অবয়ব পরিকল্পন। সাম্প্রতিককালে যৎকিঞ্চিত রাষ্ট্রীয় বা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও, প্রাচীন ও মধ্যযুগে তা তেমন দেখ। যার নি। মুসলমান শাসকেরা নানাবিধ অনুবাদ কর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাতে ভাষা অবয়বের কিছুটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কিন্তু ভাষার ব্যাপক পরিচর্যা শিক্ষা-ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে নি। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলেও পরিভাষার-প্রয়োগ প্রাচীনকাল থেকে হয়ে এসেছে।

প্রাচীন বাঙলার পরিভাষা
বাঙল। পরিভাষার কথা আলোচনার সমর চর্যাপদকর্তার। যে সব পরিভাষা নির্মাণ করেছেন সেগুলোর আলোচন। অপরিহার্য হয়ে পড়ে। চর্যাপদ হচ্ছে তান্ত্রিক সাধনার কাব্যিক নিদর্শন। তান্ত্রিক জ্ঞানতত্ত্বের বহুসংখ্যক পরিভাষা চর্যার ৪৬২টি প্রাপ্ত পদের মধ্যে পাওয়া যায়। চর্যায় পরিবেশিত পরি- ভাষার মধ্যে ভবনদী, আলিকালি, ইড়া-পিঙ্গলা, গঙ্গাযমুনা, মহাসুখ, মনগোচর, ভবপরিচ্ছিন্না, মায়া, অশ্বরদৃঢ়, ডোম্বী, নৌকা, নির্বাণ, কাপা- লিক, যোগী জিনপুর ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব পারিভাষিক শব্দের অর্থ যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায় নি বলে চর্যার অর্থ উদ্ধার দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে কেউ কেউ অস্বচ্ছ অর্থের বাহন হিসেবে চর্যাকে সন্ধ্য। ভাষায় বা আলো আঁধারি ভাষার রচিত বলে মনে করেছেন। চর্নার অর্থের অস্বচ্ছত। পারিভাষিক অর্থের অস্বচ্ছতা থেকে উৎ- সারিত। কিন্তু যাঁরা তান্ত্রিক সাধক এবং যাঁরা পারিভাষিক শব্দগুলোর অর্থ যথার্থভাবে বুঝতে পারে চর্যার ভাগ। তাঁদের কাছে আলো-আঁধারি হওয়ার কথা নয়। চর্যায় গুরুকে বোবা ও শিধ্যকে কালা বলে উপমা দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে বোবা কালাকে যেভাবে সংবোধিত করে গুরু-ও শিষ্যকে তেমনিভাবে সংবোধিত করতে পারে। চর্যাপদের পর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে আবার অন্য ধরনের এক রাশ পারি- ভাষিক শব্দ পাওয়া যায়। সেগুলো মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যের অন্য ফোন বিভাগে তেমন প্রচলিত নেই। বৈষ্ণবীয় পরিভাষাগুলোর মধ্যে মধুর রস, উজ্জ্বল রস, ভাব, মহাভাব, অভিধার, রাগ, অনুরাগ, রূপানুরাগ, রতিভাব, স্বকীয়, পরকীয়, রাগানুগা, রাগায়িকা, দিখ্যোনাাদ, লীলা, ভাব- সম্মিলন এ ধরনের গারো অনেক শব্দের সাক্ষাৎ মেলে যেগুলো সচরাচর অবৈষ্ণবীর রণালোচনায় ব্যবহৃত হয় না। বৈষ্ণবসাহিত্য বৈষ্ণব-দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈষ্ণব-দর্শন নির্মাণ করতে গিয়ে বৈষ্ণব মহাজনেরা যে জ্ঞানতত্ত্বের বিকাশ সাধন করেছেন তাঁর প্রয়োজনেই এসব পরিভাষা গড়ে তুলতে হয়েছিল। বৈষ্ণবদর্শনের মতো দেশীয় জ্ঞানের চর্চা বাঙলাভাঘায় আর খুব বেশী হয় নি। বাউলতত্ত্বকে বৈষ্ণবতত্ত্বের সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। পরবর্তীকালে এদেশে মৌলিক জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য গড়ে ওঠে নি। ফলে মৌলিক জ্ঞানের সঙ্গে গড়ে ওঠা পরিভাষ। নির্মাণের কাজও হয়নি।

আধুনিক যুগে বাঙলা পরিভাষা
আধুনিক বাঙলা পরিভাঘার সূচনা আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। আধুনিক যুগের পরিভাষাকে আমরা অনুবাদাত্মক পরি- ভাষা বলে অভিহিত করতে পারি। কারণ এগুলে। ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বাঙল। রূপান্তর করতে গিয়েই সৃষ্টি হয়েছে, মৌল জ্ঞানচর্চাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে নি। দেশীয় লোকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য ইউরোপীয় ধর্মযাজকেরা শ্রীরামপুরে খ্রীস্টান মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা সেখানে শিক্ষাদানের জন্য বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই বিদ্যায়তনে ইউরোপীর বিজ্ঞানাদি পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হয়। বিজ্ঞান বিষয়ক শাস্ত্রের পূর্ব প্রচলন না থাকার কারণে ইউরোপীয় বিদ্যাকে দেশীয় ভাষার রূপান্তর করতে গিয়ে সেই সব বিদ্যার মূল-ধারণ। তথ্য পরিভাষাগুলোর বাঙলা রূপান্তর করতে হয়েছিল। শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যাপক জন ম্যাকের (১৭৯৯-১৮৪৫) অবদান এ ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয়। তিনি বাঙলায় রসায়নবিদ্যার প্রথম বই রচনা করেন। বংটির নাম 'কিমিয়াবিদ্যাসার'। জন ম্যাকের সঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় জগৎবিখ্যাত উইলিয়াম কেরীর পুত্র ফেলিক্স কেরীর কথা। তিনি উনচল্লিশ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ 'ব্যবচ্ছেদ বিদ্যাভিধান' প্রস্তুত করে বাঙলা অনুবাদায়ক পরিভাধার দীর্ঘযাত্রার সূচনা করেন। ফেলিক্স কেরী পরিভাষা সৃষ্টির জন্য প্রাচীন কোষ-গ্রন্থাদির সহায়ত। গ্রহণ করেছেন। যেখানে পুরাতন পরিভাষ। পান নি সেখানে তিনি যৌগিক ও সাধু শব্দের মিলন ঘটিয়ে নতুন পরিভাষ। তৈরী করেছেন। তিনিই Anatomy-এর 'ব্যবচ্ছেদ- বিদ্যা, Solid-এর 'ঘন', Liquid-এর 'দ্রব', Muscle-এর জন্য 'মাংসপেশী', Nerve-এর জন্য 'নাড়ী', Vain-এর জন্য 'শিরা', Chemistry-এর 'রসায়নবিদ্যা', Surgery-এর জন্য 'শৈল্য চিকিৎসা', Economics-এর জন্য 'অর্থশাস্ত্র' ইত্যাদি পরিভাষা নির্ধারণ করেছিলেন।
শ্রীরামপুরের মিশনারীর। বাঙলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজী পাঠ্য-গ্রন্থগুলোর পঠন-পাঠনের অসুবিধার কথা চিন্তা করে তাঁর। বাঙালী ছাত্রদের জন্য সেগুলোর বিষয়বস্তু বাঙলা ভাষায় রূপান্তর করেন। সেই সূত্রেই তাঁরা ইংরেজী ভাষার বাঙলা প্রতি- শব্দ বা সমার্থক শব্দ তৈরী করেন। ইরোরোপীয় জ্ঞানের মূল পরিভাষা- গুলো বাঙলায় রূপান্তরিত হয়ে যে অবয়ব ধারণ করে তাতেই বাঙলা পরি- ভাষার ঐতিহ্য সূচিত হয়। বাঙলা পরিভাষা শুধু বাঙলায় নতুন শব্দ নির্মাণ মাত্র নয়, বরং ইয়োরোপীয় ধারণায় পুষ্ট পরিভাষার বাঙলা রূপান্তরও- বটে। সে-ফারণে স্বয়ংভর পরিভাগ। নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিভাগ। নির্মাণকারীরা যে সুবিধা স্বাভাবিকভাবে লাভ করে থাকেন বাঙলার পরিভাষা রূপান্তর করতে গিরে সে স্বাভাবিক সুবিধা থেকে তাঁরা বঞ্চিত থেকেছেন। ইউরোপীয় পরিভাষা নির্মাণকারীকে দ্বিভাবিক না হলেও চলে কিন্তু বাঙলায় যাঁরা পরিভাষা তৈরী করতে আসেন তাঁদের অবশ্যই দ্বিভাষিক হতে হয়। তাঁদের বিষয়টা যেমন ভালভাবে জানতে হয়, তেমনি জানতে হয় সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলো।
বাঙলা পরিভাষ। নির্মাণকারীকে একই সঙ্গে পরিভাষা নির্মাণ ও পরি- ভাষ। অনুবাদ দুটো কাজ করতে হয়। ঐকভাষিক পরিস্থিতিতে পরি- ভাষা নির্মাণের চেয়ে কর্মটি জটিল। কারণ এতে করে পরিভাষ। নির্মাণ- কারীকে একই সঙ্গে দুটো রীতি-নীতি মানতে হয়। একটি হচ্ছে বাঙলা ভাষার শব্দ নির্মাণের নীতি, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজী ভাষার শব্দার্থকে বাঙলা ভাষায় বদল করণের রীতি। এই দুটো কর্ম একসঙ্গে সম্পাদনের যে যোগ্যতা তা সহজলভ্য নয়। ভাষার অন্তর্গঢ় শৃঙ্খলার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ থাকলে ভাষার উপাদান ব্যবহার করে নতুন শব্দ নির্মাণ করা যার, তা অনেকেরই নেই; আবার বিষয়ের অন্তর্গুঢ় শৃঙ্খলার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ থাকলে বিষয়কে অবলীলায় ভাষান্তর করা যায় তা অনেকেরই নেই। তদুপরি ইংরেজী ও বাঙলা ভাষার সাংস্কৃতিক পটভূমির পার্থক্যও অনেক শব্দের অর্থ নির্ধারণে সমস্যা নিয়ে আসে। সহজ কথার ভাষাগত, বিষয়গত ও সংস্কৃতিগত প্রতিসাম্য উপলব্ধির উপতা যতদিন থাকবে ততদিন ইংরেজী থেকে রূপান্তরিত বাঙলা পরিভাষা সম্পর্কে বিতর্ক থাকবে। আমরা পরিভাষা নির্মাণের সংকট সম্বন্ধে আলোচনা করেছি, পরিভাষ। উপলব্ধির সংকট সম্বন্ধে আলোচন। করি নি। 'বাঙলা পরিভাষা কঠিন প্রতিভাত হয় কেন?' প্রশ্নটি পরিভাষা উপলব্ধির সংকটকে স্পর্শ করে যায়।

পরিভাষা উপলব্ধির সংকট
'বাঙলা-পারভাষ। কঠিন প্রতিভাত হয় কেন? প্রশ্নটি পরিভাষা উপলব্ধির সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরিভাষা-নির্মাণের সঙ্গে সমস্যাটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। পরিভাষা নির্মাণ সহজ কর্ম তা' আমরা বলছি না, কোনে। কোনো ধারণার পরিভাষা-নির্মাণ রীতিমতে। সময়সাপেক্ষ ও ভাবনাসাপেক্ষ ব্যাপার। কোন কোন সংস্কৃতি-নির্ভর ধারণার পরিভাষা সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব মনে হয়। তব কঠিন মনে হওয়ার ব্যাপারটি নির্মাণ পর্যায়ে নেই, নির্মিত পরিভাষার উপলব্ধির পর্যায়ে আছে। অনুযোগটি উত্থাপিত হয় ভোক্তা কিংবা ব্যবহারকারীদের পক্ষ থেকে, নির্মাণকারীদের পক্ষ থেকে নয়। বাঙল। পরিভাষ। কঠিন প্রতিভাত হওয়ার পেছনে কোনে। ভাষাতাত্ত্বিক কারণ নিহিত আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য আমরা সামান্য একটি জরিপ করেছিলাম। সে জরিপের বিস্তারিত ব্যাখা। আমর। অনাত্র দিয়েছি (দ্রঃ বাঙলা পরিভাষা : ইতিহাস ও সমস্যা)। এখানে আামর। তার দুএকটি কথা থালোচন। করবে।
বাঙল। পরিভাগা-নির্মাণ ও প্ররোগের সঙ্গে জড়িত ৪০ জন ব্যক্তির মতামত যাচাই করার জন্য আমরা একটি প্রশ্নমাল তৈরী করেছিলাম। যাঁরা জরিপে 'নির্বাচিত ব্যক্তি' হিসেবে এসেছিলেন তাঁর। সকলেং উচ্চশিক্ষিত। উত্তর-দাতার। উচ্চতর পেশায় নিয়োজিত ও পরিভাষ। সমস্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এঁদের মধ্যে আছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ভাষা পরিকল্পনা সংস্থার বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারী, নানা ধরনের প্রকৌশলী, সাংবাদিক, অনুবাদক, মনোবিজ্ঞানী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও উর্ধ্বতন সরকারী কর্মচারী।
জরিপে দেখা যাচ্ছে পরিভাষা-নির্মাণ, পরিভাষা-প্রচার এবং পরিভাষা প্ররোগে কোনে। ধারাবাহিক প্রশাসনিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গতি নেই। ফলে প্রয়োগকারীর। নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগমুখর হয়ে ওঠেন। প্রয়োগ- কারীরা নির্মাণকারীদের কাছে 'সহজ সুন্দর বোধগম্য এবং ব্যবহারোপযোগী' পরিভাষ। প্রত্যাশা করেন। জরিপে আরো দেখা যাচ্ছে এ ধরনের প্রত্যাশার কোনে। ভাষাতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই। সকল শব্দকে সহজ করা যায় না, সকল ভাব কিংবা ধারণাকে সুন্দর করা যায় না। চিন্তাজগতের কঠিনত। ও অসুন্দরতা পারিভাষিক শব্দের জগৎকেও প্রভাবিত করতে পারে।
আমরা আগেই বলেছি পরিভাষা এক অর্থে নতুন শব্দ সৃষ্টি। নতুন শব্দ সাধারণত 'পূর্ব-পরিচিত' হয় না। যে ব্যক্তি বা সমাজ পূর্ব-পরিচিত শব্দ না হলে তাকে গ্রহণ করতে চায় না, সে ব্যক্তির কাছে কিংবা সমাজের কাছে পরিভাষ। অবশ্যই কঠিন প্রতিভাত হবে। পরিভাষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই 'অপরিচিতি' ও 'অগ্রহণীয়তা'র সমস্যার কথা কোনে। কোনে। পণ্ডিত আগেই বলেছিলেন। তাঁদের ধারণা থেকেই আসর। কল্পনানুমান বা হাই- পোথেসিস গ্রহণ করেছিলাম যে, "পরিভাষ। 'অপরিচিত শব্দ' বলেই কারো কারো কাছে কঠিন মনে হয়।" এই কল্পনানুমান যাচাই করার জন্য আমরা ১০০ শব্দের একটি তালিকা প্রস্তুত করে উত্তরদাতাদের পূর্ব পরিচিতির মাত্রা নির্ণয় করেছি। প্রদত্ত ১০০ শব্দের মধ্যে ২৫টি শব্দ ছিল নবসৃষ্ট শব্দ। এ-সব শব্দ আগে কোনো অভিধানে কিংবা শব্দকোথে ব্যবহৃত হয় নি। বাঙলাভাষার শব্দ-নির্মাণ সম্ভাবনাকে প্রয়োগ করে আমরা এই শব্দগুলো বানিয়েছি। শব্দগুলোর কোনো অর্থ থাকারও কথা নয়। ১০০ শব্দের তালিকাটি এই:
১. অধ্যাদেশ, ২ অধ্যায়োগ, ৩. অস্থায়ী, ৪. অভাষ্য, ৫. অভিভাসন, ৬. অভিভাষণ, ৭. অবিকল, ৮. অনুদুসম্যান, ৯. অপচয়, ১০. অবচয় ১১. আডডা, ১২. আম্ব, ১৩. আষাঢ়, ১৪. ইসক্রা, ১৫. ইন্ধন, ১৬. ইসটুপিট, ১৭. ঈধান, ১৮. ঈদলা, ১৯. ঈশ, ২০. এশকার, ২১. এলা, ২২. একৈতা, ২৩. ঐরাবত, ২৪. ঐরান, ২৫. ওদাট,, ২৬. ওলা, ২৭. ওকা, ২৮. ওঙ্কার, ২৯. ঔষধ, ৩০. ঔঞ্চাল, ৩১. উমান, ৩২. কদু, ৩৩. কীবাচ্চ, ৩৪. কীলক ৩৫. কৃপণ, ৩৬. কৃষক. ৩৭. কুশ্রী, ৩৮. ক্রম, ৩৯. খ্রীষ্টান, ৪০. থোব্দ ৪১. খেপ, ৪২. গবাদি, ৪৩. গব্বাবাজ, ৪৪. গোণশ্রী, ৪৫. ঘ্রাণ, ৪৬. চল, ৪৭. চর, ৪৮. চৌনা, ৪৯. ছোবা, ৫০. ছুপ, ৫১. জীবন, ৫২. জো, ৫৩. জনাব, ৫৪. জাহান্নাম, ৫৫. বাঙ্কার, ৫৬. টোবাই, ৫৭. দোলা, ৫৮. দীপ্র, ৫৯. দো-ভাষা, ৬০. ধনু ৬১. নলি, ৬২. নূতি, ৬৩. নুমা, ৬৪. পাকী, ৬৫. পতি, ৬৬. প্রকল্প, ৬৭. গ্রীক্ত, ৬৮. পরিভাষা, ৬৯. ফাবা, ৭০. ফেমাস, ৭১. ফেদাইন, ৭২. ফেলনা, ৭৩. ফেইট, ৭৪. ব্রোনা, ৭৫. বেলা, ৭৬. বলি, ৭৭. ভাল্লাগা, ৭৮. ভালা, ৭৯. ভানুমতী, ৮০. মামী, ৮১. মালাই, ৮২. মামলেট, ৮৩. মূল্যোদ্ধৃতি, ৮৪. মূল্যায়ন, ৮৫. রাষ্ট্র, ৮৬. রেডিও, ৮৭. লোষ্ট্র, ৮৮. শ্রান্ত, ৮৯. সংবাদ, ৯০, সন্দেশ, ৯১. সম্পূরক, ৯২. স্বভাষা, ৯৩. প্রাপক, ৯৪. বেগম, ৯৫ বিসৃষ্টিবাদ, ৯৬. মানুই, ৯৭. সোনা, ৯৮. স্তম্ভ, ৯৯. সিঞ্চক, ১০০. স্থভূতি।
শব্দতালিকার আমরা কঠিন তৎসম জাতীয় শব্দ দিয়েছি; যেমন অধ্যা- দেশ, অধ্যায়োগ; প্রচলিত মৌখিক শব্দ দিয়েছি; যেমন অবিকল, কদু, কৃষক; বিদেশী শব্দ দিয়েছি যেমন অম্বুদুসম্যান, জাহান্নাম, ফেমাস, ফেইট, রেডিও। শব্দ তালিকায় আমরা কিছু সহজ নবসৃষ্ট শব্দ দিয়েছি; যেমন ওদাট, ওকা, মানুই, নুতি, ছোবা, ঈদলা, ইত্যাদি। ভাষাতাত্ত্বিক সংগঠনের দিক থেকে শব্দ গুলোকে কঠিন বলা যায় না। কারণ এগুলোর গঠন যথাক্রমে Vcvc, vcv, cvcvv, cvCv, cvcv, VCCV (এখানে = স্বরধ্বনি, C= ব্যঞ্জন ধ্বনি)। বাঙলা শব্দের সংগঠনের মধ্যে এ-সব সংগঠন বহুল প্রচলিত। সংগঠন সহজ ও প্রচলিত হওয়। সত্ত্বেও শব্দগুলো উত্তরদাতার। গ্রহণ করতে চান নি। কারণ শব্দগুলো তাঁদের অপরিচিত এবং এগুলোর কোনো অর্থ তাদের জানা নেই। অথচ গঠনগত দিক থেকে এগুলোর চেয়ে অনেক জটিল শব্দ উত্তরদাতার। গ্রহণ করেছেন: দৃষ্টান্ত 'অধ্যাদেশ', 'ঐরাবত', 'খ্রীষ্টান', 'মূল্যোদ্ধৃতি', 'সম্পূরক' ইত্যাদি। অর্থাৎ শব্দের গঠনগত কাঠিন্যের বা জটিলতার চেয়েও উত্তরদাতাদের কাছে অপরিচিতির ব্যাপারটি প্রাধান্য লাভ করেছে।
অপরিচিতির ব্যাপারটি আমরা একই আার্থ-উপাদানের (Semantic elements) জন্য একাধিক অবয়ব-উপাদান (Corpus element) ব্যবহার করেও যাচাই করার চেষ্টা করেছি। ১৫টি আর্থ উপাদানের জন্য আমর। ৬০টি অবয়ব উপাদান ব্যবহার করে পরিচিতির আপেক্ষিক গুরুত্ব নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি। আর্থ-উপাদানগুলো হচ্ছে ১. টেলিভিশন ২. উড়োজাহাজ ৩. বিমানবাল। ৪. বাতি ৫. কমরেড ৬. মঞ্জুরী ৭. রাষ্ট্রপতি ৮. রেজিস্ট্রার ১. ন্যায়পাল ১০. প্রাদিনাম ১১. শাপলা ১২. সম্পূরক ১৩. বিশ্রী ১৪. খেপ ১৫. মঞ্জুরী ইত্যাদি। 'মঞ্জুরী' এই অবয়বটি দু-বার ব্যবহৃত হয়েছে। বড় রকমের কোন মানসিক পরিবর্তন আসে কিনা দেখবার জন্য। দেখা বাচ্ছে ১ নম্বর আর্থ-উপাদানের জন্য 'টেলিভিশন' হচ্ছে সর্বাধিক পরিচিত উপাদান, তারপরে আসে 'দূরদর্শন', তারও পরে আসে 'দুরেক্ষণ'। 'স্বভূতি'কে টেলিভিশনের আর্থ-উপাদান হিসেবে গ্রহণ করানে। যায়নি। অথচ অবয়বের দিক থেকে 'টেলিভিশন' শব্দটি 'স্বভূতি'-এর চেয়ে বৃহদায়তন। তেমনি 'বিমানবালা'র জন্য 'দোলা'কে গ্রহণ করানো যায়নি। 'বাতি'র জন্য 'ওদাট' গ্রহণ করানে। যায় নি। 'শাপলা'র জন্য 'ওকা'-কে গ্রহণ করানে। বায় নি। (বিস্তারিত ব্যাখার জন্য পূর্বোক্ত গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)। 'মঞ্জুরী'র জন্য 'নুতি'কে গ্রহণ করানো যায় নি। অথচ সাংগঠনিক দিক থেকে 'মজুরী'র চেয়ে 'নুতি' শব্দটি অনেক সহজ।
জরিপের শব্দ গ্রহণ প্রবণতা বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে শব্দের অব- রবের চেয়ে তার আর্থ-উপাদানের পরিচিতি উত্তরদাতাদের কাছে শব্দ গ্রহণের মৌল বিষয় বলে প্রতিভাত হরেছে। তাই যদি সত্যিকার শব্দ গ্রহণ প্রবণতা হয়, তবে নির্মাণকারীদের উপর সহজ শব্দ নির্মাণের দায়িত্বের বোঝা হাস্তা হয়ে যায়। পরিভাষ। নতুন-শব্দ, 'অপরিচিত শব্দ'। সুতরাং নতুনকে পরিচিত করাতে হবে। তাকে নির্মাণকারী সহজও করতে পারে, কঠিনও করতে পারে। সেটা নির্ভর করে বিষরগত ও ভাষাগত প্রয়োজনের উপর। নির্মাণকারী পরিভাষা-নির্মাণ করতে পারবে কিন্তু তাকে সহজ করতে পারবে না। যে দায়িত্ব অন্য কাউকে নিতে হবে যে নির্মিত পরি- ভাষার আর্থ-উপাদানফে শ্রোতা কিংবা পাঠকের জ্ঞানগত পরিচিতির পরিমণ্ডলে নিয়ে আসবে। সাধারণত এই দায়িত্ব বহন করতে পারে ভাষা পরিকল্পনা সংস্থা। ডেল্লা ক্রুস্কা, ফরাসী একাডেমী কিংবা সুইডিশ একাডেমী একাজ করে এসেছে। উনিশ শতকে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ' একাজ করেছিল। বর্তমানে ঢাকার বাঙলা একাডেমী ও কলকাতার বাঙলা অকাদেমী এধরনের কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। 

Related Posts