মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৯ অক্টোবর, সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতা খ্যাত সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারে। তার বাবা গৌচপ্রম রায়চৌধুরী ছিলেন চিত্রশিল্পী-ফটোগ্রাফার। মা অমিতা ছিলেন পাণিহাটিস্থিত নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (রোনাল্ড রস-এর সহায়ক) জ্যেষ্ঠ কন্যা। কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিষদের সংরক্ষিত সংগ্রহশালার (মিউজিয়াম) তথ্য অনুযায়ী মলয় রায়চৌধুরীর ঠাকুরদা লক্ষীনারায়ণ ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার-আর্টিস্ট। তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীও স্বনামধন্য একজন লেখক। ১৯৬১ সালে এক ইশতেহার প্রকাশিত হয় পাটনায়। সেই থেকে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গসাহিত্যের আনাচে কানাচে। প্রতিষ্ঠান বিরোধী সেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত মলয় রায়চৌধুরীর হাত ধরেই। জিওফ্রে চসারের একটা কবিতা থেকে হাংরি শব্দটি বেছে নিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি আন্দোলনের শুরু থেকেই সাথে ছিলেন তাঁর বন্ধু দেবী রায়, দাদা সমীর রায়চৌধুরী ও কবি শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায়। পরবর্তীকালে উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র এবং তার বান্ধবী আলো মিত্র, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরীসহ আরও অনেকে এ আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৬৪ সালের হাংরি বুলেটিনে মলয় রায় চৌধুরী’র ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা প্রকাশিত হয় এবং ‘হাংরি বুলেটিন ১৯৬৪’ প্রকাশের পরে ভারতীয় আদালতে হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৬৪ সালে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি লেখার জন্য রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন মলয়। ১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাংরি আন্দোলনকারীদের ১১ জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ড বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) ও ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়; এদের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৬৫ সালের মে মাসে অন্য সবাইকে রেহাই দিয়ে কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশিট দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। প্রদীপ চৌধুরী বিশ্বভারতী থেকে বহিষ্কৃত হন। সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতা থেকে মফঃস্বলে বদলি করে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তারের সময় মলয় রায়চৌধুরীকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে দুই কিলোমিটার হাঁটিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে ব্যাংকশাল কোর্ট মলয় রায়চৌধুরীকে দুশো টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে মলয় রায়চৌধুরী কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। ১৯৬৭ সালের ২৬ জুলাই হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দেন। মলয় রায়চৌধুরীর প্রকাশিত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই শতাধিক। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদেও তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। 'শয়তানের মুখ', 'জখম', 'ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস', 'নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র', 'কৌণপের লুচিমাংস', 'মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো' তার উল্লেখযোগ্য রচনা। তাঁর ১০টি কবিতাগ্রন্থ, ১০টি উপন্যাস, দুটি ডিটেকটিভ উপন্যাস, একটি ইরোটিক নভেলা, ১২টি সমালোচনা গ্রন্থ, চারটি জীবনী এবং বহু অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। বহুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানান অসুখে ভুগছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর ৮৪ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

Showing 1-1 of 1 Books